বনলতা সেন কবিতা- জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতা

বনলতা সেন – জীবনানন্দ দাশ

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ‘পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা,
সে-ই চিনতে পারে তারে নিখিল-অন্ধকারের ‘পর।

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

বনলতা সেন কবিতা ব্যাখ্যা

এই কবিতাটি বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি জীবনানন্দ দাশের “অন্তর্যামী” কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটিতে কবি একটি অদ্ভুত নারী চরিত্রের অবতারণা করেছেন, যার নাম বনলতা সেন। বনলতা সেন একজন বিমূর্ত নারী, যিনি কবির কল্পনায় বাস করেন। তিনি একজন সুন্দরী নারী, যার চুল অন্ধকার বিদিশার নিশার মতো, এবং মুখ শ্রাবস্তীর কারুকার্য। তিনি একজন দূরবর্তী নারী, যিনি কবির কাছে একজন চিরন্তন রহস্য। কবিতাটির প্রথম স্তবকে কবি বলেছেন যে তিনি একজন ক্লান্ত প্রাণ। তিনি জীবনের সমুদ্রের মাঝে হারিয়ে গেছেন। কিন্তু বনলতা সেন তাকে দু-দণ্ডের জন্য শান্তি দিয়েছেন। তার উপস্থিতি কবির জীবনে আলো এবং আনন্দের সঞ্চার করেছে। দ্বিতীয় স্তবকে কবি বনলতা সেনের রূপের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি একজন অপূর্ব সুন্দরী নারী। তার চুল অন্ধকার বিদিশার নিশার মতো ঘন এবং কালো। তার মুখ শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মতো সুন্দর এবং মায়াবী। তৃতীয় স্তবকে কবি বনলতা সেনের দূরত্বের কথা বলেছেন। তিনি একজন দূরবর্তী নারী। তিনি কবির কল্পনায় বাস করেন। কবি তাকে শুধুমাত্র অন্ধকারে দেখেছেন। চতুর্থ স্তবকে কবি বনলতা সেনের রহস্যের কথা বলেছেন। তিনি একজন রহস্যময় নারী। কবি তার সম্পর্কে সব কিছু জানতে চান, কিন্তু তার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন না। পঞ্চম স্তবকে কবি বনলতা সেনের প্রতীকী অর্থের কথা বলেছেন। তিনি একজন অনন্ত প্রেমের প্রতীক। তিনি কবির জীবনে আনন্দ এবং শান্তি এনে দেন। বনলতা সেন কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য কবিতা। এটি কবির কল্পনার জগতের একটি অনন্য সৃষ্টি। এটি একটি চিরন্তন প্রেমের কবিতা, যা কবিতার পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য গেঁথে থাকবে।

কবিতাটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

  • বনলতা সেন একজন অদ্ভুত নারী, যিনি কবির কল্পনায় বাস করেন।
  • তিনি একজন সুন্দরী নারী, যার চুল অন্ধকার বিদিশার নিশার মতো, এবং মুখ শ্রাবস্তীর কারুকার্য।
  • তিনি একজন দূরবর্তী নারী, যিনি কবির কাছে একজন চিরন্তন রহস্য।
  • বনলতা সেন একজন অনন্ত প্রেমের প্রতীক।

বনলতা সেন কবিতার মূলভাব | বনলতা সেন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

জীবনানন্দ দাশের “বনলতা সেন” কবিতাটি মৃত্যুহীন মানবসত্তার অন্তর্লোককে উজ্জীবিত করা মহিমাময়ী প্রেমের জয়গান। কবি এই কবিতায় ব্যক্তিসত্তার মৃত্যুর পরও মানবসত্তার অমরত্বের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ব্যক্তিসত্তা হয়তো মৃত্যুতে লীন হয়ে যায়, কিন্তু মানবসত্তা ও সভ্যতা চিরকাল টিকে থাকে।

কবি তাঁর আপন চেতনায় অবিনাশী মানবসত্তার যুগ যুগ ধরে পথ চলার গতি ও ক্লান্তি অনুভব করেছেন। সেই মৃত্যুহীন মানবসত্তার অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে তিনি হাজার বছর ধরে হেঁটে চলেছেন পৃথিবীর পথে পথে। তিনি সুবিস্তৃত প্রাচ্যের সিংহল সমুদ্র থেকে রাতের অন্ধকারে মালয় সাগর পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছেন সমুদ্র পথে। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে তৃতীয় শতকের পরাক্রান্ত রাজা বিম্বিসার ও আশশাকের জগৎ থেকে বিস্মৃতপ্রায় অতীতের বিদর্ভ নগর পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন।

এই বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কবি এখন এক ক্লান্তপথিক। সমুদ্রের বুকে একের পর এক তরঙ্গের অভিঘাতে যেমন সাদা ফেনার সৃষ্টি হয়, কবি তার চলার পথের দুধারে জীবনের যে বিচিত্র তরঙ্গকে উছলে উঠতে দেখেছেন, তা এখন সেই সমুদ্র তরঙ্গের মতােই সফেন হয়ে উপচে পড়েছে তার চতুর্দিকে।

এই সফেন জীবন সমুদ্রের মধ্যে কবি দু’দণ্ড শান্তি পেয়েছিলেন নাটোরের বনলতা সেনের কাছে। বনলতা সেন কবির কাছে এক শাশ্বত নারীর প্রতীক। তিনি প্রেম ও সৌন্দর্যের অনিঃশেষ দীপ্তিতে মহীয়ান। কবি তাঁর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন মৃত্যুহীন মানবসত্তার অন্তর্লোককে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা।

বনলতা সেন কবিতায় কবি কীভাবে মৃত্যুহীন মানবসত্তার কথা বলেছেন?

বনলতা সেন কবিতায় কবি মৃত্যুহীন মানবসত্তার কথা বলেছেন দুটিভাবে। প্রথমত, কবি বলেছেন যে ব্যক্তিসত্তা হয়তো মৃত্যুতে লীন হয়ে যায়, কিন্তু মানবসত্তা ও সভ্যতা চিরকাল টিকে থাকে। কবি তাঁর আপন চেতনায় অবিনাশী মানবসত্তার যুগ যুগ ধরে পথ চলার গতি ও ক্লান্তি অনুভব করেছেন। সেই মৃত্যুহীন মানবসত্তার অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে তিনি হাজার বছর ধরে হেঁটে চলেছেন পৃথিবীর পথে পথে। সুতরাং, কবির কাছে মৃত্যুহীন মানবসত্তা হল একটি অমর শক্তি যা যুগ যুগ ধরে টিকে থাকে।

দ্বিতীয়ত, কবি বনলতা সেনকে এক শাশ্বত নারীর প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। বনলতা সেন কবির কাছে প্রেম ও সৌন্দর্যের অনিঃশেষ দীপ্তিতে মহীয়ান। তিনি কবির মধ্যে মৃত্যুহীন মানবসত্তার অন্তর্লোককে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তাই, বনলতা সেন কবির কাছে মৃত্যুহীন মানবসত্তার এক প্রতীক।

বনলতা সেন কবিতায় বনলতা সেন চরিত্রের বৈশিষ্ট্য কী?

বনলতা সেন কবিতায় বনলতা সেন চরিত্রটি একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক চরিত্র। তিনি একজন সুন্দরী নারী, কিন্তু তার সৌন্দর্য শুধুমাত্র শারীরিক নয়, বরং তার আত্মার গভীরতা এবং রহস্যময়তায় নিহিত। তিনি একজন স্বাধীনচেতা নারী, যিনি নিজের জীবনে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি একটি সুন্দর এবং নিরাপদ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন।

বনলতা সেন চরিত্রের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:

  • সৌন্দর্য: বনলতা সেন একজন অত্যন্ত সুন্দরী নারী। তার চুল কালো, তার ঠোঁট লাল, এবং তার চোখ নীল। তার সৌন্দর্য এতটাই আকর্ষণীয় যে কবি তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়েন।
  • স্বাধীনতা: বনলতা সেন একজন স্বাধীনচেতা নারী। তিনি নিজের জীবনে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি অন্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে চান না।
  • রহস্যময়তা: বনলতা সেন একজন রহস্যময় নারী। তার অতীত সম্পর্কে খুব কম জানা যায়। তিনি কোথা থেকে এসেছেন, তার পরিবার কেমন, এবং তার জীবনে কী ঘটেছে তা কবিতায় উল্লেখ করা হয়নি। এই রহস্যময়তা তার চরিত্রকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
  • স্বপ্নদ্রষ্টা: বনলতা সেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি একটি সুন্দর এবং নিরাপদ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে ভালোবাসা এবং সহানুভূতির মাধ্যমে এই পৃথিবীকে একটি আরও ভাল জায়গা করা সম্ভব।

বনলতা সেন চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় নারী চরিত্র। তিনি একজন নারীর শক্তি, স্বাধীনতা, এবং স্বপ্নের প্রতীক।

বনলতা সেন কবিতা প্রশ্ন উত্তর

প্রশ্নঃ বনলতা সেন কবিতা কোন কাব্যগ্রন্থের?

উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ  ডিসেম্বর ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তার বনলতা সেন নামক “তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে” কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেন। জন্মঃ ১৭ ফেব্রুয়ারী, ১৮৯৯, বরিশাল।

প্রশ্নঃ বনলতা সেন কবিতার লেখক কে?

উত্তরঃ জীবনানন্দ দাশ

প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশ কবে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

উত্তরঃ বরিশালে ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি।

প্রশ্নঃ রূপসী বাংলার কবি কে?

উত্তর জীবনানন্দ দাশ |

প্রশ্নঃ বাংলা সাহিত্যে তিমির হননের কবি নামে পরিচিত কোন কবি?

উত্তরঃ কবি জীবনানন্দ দাশ।

প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি কাব্যের নাম উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ঝরাপালক [১৯২৭), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩১), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির [১৯৪৮] প্রভৃতি।

প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশের একটি উপন্যাসের নাম লেখ।

উত্তরঃ ‘মাল্যবান’। জীবনানন্দ দাশের একটি প্রবন্ধ গ্রন্থের নাম লেখ। উত্তরা কবিতার কথা’ ।।

প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশ অধ্যাপনা ছাড়া এক সময় কোন পেশাও গ্রহণ করেছিলেন?

উত্তরঃ সাংবাদিকতা।

প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশ কোথা থেকে ইংরেজিতে এম.এ. পাস করেন?

উত্তরঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশ কত সালে এম.এ. পাস করেন?

উত্তরা ১৯২১ সালে ।

প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশের পিতার নাম কী?

উত্তরাঃ  সত্যানন্দ দাশ ।

প্রশ্নঃ জীবনানন্দ দাশের মাতার নাম কী?

উত্তরঃ কবি কুসুমকুমারী দাশ।

প্রশ্নঃ কুসুম কুমারী রচিত দুটি বিখ্যাত চরণ হলাে

উত্তরঃ “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।”

প্রশ্নঃ জীবনানন্দের ভাই ও বােনের নাম কী?

উত্তরঃ অশোকানন্দ দাশ ও সুচরিতা দাশ।

 

আরো পড়ুনঃ বনলতা সেন কবিতার প্রশ্ন উত্তর সংক্ষিপ্ত