দুই বিঘা জমি কবিতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা

দুই বিঘা জমি কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমি কবিতা

“দুই বিঘা জমি কবিতা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা যা গ্রামবাংলার শ্রেণি বৈষম্য এবং অবিচারের বিষয়গুলি নিয়ে অনুসন্ধান করে।

দুই বিঘা জমি কবিতা

— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের —

শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে।’
কহিলাম আমি, ‘তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই –
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়জোর মরিবার মতো ঠাঁই।
শুনি রাজা কহে, ‘বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা –
ওটা দিতে হবে।’ কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, ‘করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!’
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে।’

পরে মাস-দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে –
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য –
কত হেরিলাম মনোহর ধাম, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমত কাটে বছর পনেরো-ষোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হল।।

নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধুলি –
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ –
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধু জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে –
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি, রথতলা করি বামে,
রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে।।

ধিক্ ধিক্ ওরে, শত ধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার – এই কি জননী তুমি!
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা!
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ –
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ!
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী, হাসিয়া কাটাস দিন!
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন –
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন!
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ী, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ, যত করো সাজ, ছিলে দেবী – হলে দাসী।।

বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি –
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে সেই আমগাছ একি!
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন –
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন।
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা।।

হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এল মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, ‘আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব –
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।’
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ –
শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, ‘মারিয়া করিব খুন।’
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।
আমি কহিলাম, ‘শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়!’
বাবু কহে হেসে, ‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’
আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোরে ঘটে –
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।।

কবিতাটির সংক্ষিপ্তসার:

এই কবিতাটি একজন দরিদ্র কৃষক, উপেন্দ্রনাথের জীবনযন্ত্রণার কাহিনী। তার মাত্র দুই বিঘা জমি ছিল যা তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ঋণের বোঝা ও জমিদারের নির্যাতনের কারণে সে তার জমি হারিয়ে ফেলে এবং পরিবার নিয়ে ভিক্ষুক জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। বহু বছর পরে সে ফিরে আসে তার গ্রামে এবং দেখতে পায় তার জমি এখন একটি বাগানে পরিণত হয়েছে। সে বাগানের মালিকের কাছে দুটি আম চেয়ে ভিক্ষা চায় কিন্তু তাকে বিতাড়িত করা হয়।

কবিতাটির তাৎপর্য:

“দুই বিঘা জমি” কবিতাটি শুধু একটি কৃষকের জীবনযন্ত্রণার কাহিনী নয়, বরং এটি সমাজের অসমতা, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদ।

কবিতাটির বিশেষত্ব:

  • কবিতাটিতে গ্রাম বাংলার বাস্তব চিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
  • কবিতাটির ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল।
  • কবিতাটিতে ব্যবহৃত উপমা, রূপক ও অন্যান্য অলঙ্কারগুলি কবিতাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

Also Read : হাট কবিতা – কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি কবিতা | Kumor Para Gorur Gari Lyrics In Bengali

দুই বিঘা জমি কবিতার ব্যাখ্যা:

কবিতাটি একটি দরিদ্র কৃষকের গল্প বলে যেখানে তাকে একজন অত্যাচারী জমিদারের কাছে তার দুটি বিঘা জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। কৃষক কঠোর পরিশ্রম করে জমি চাষ করেছিল এবং তার আশা এবং স্বপ্নগুলি তার চারপাশে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু জমিদার, যিনি ধনী এবং ক্ষমতাশালী, তিনি কেবল তার কাছ থেকে জমিটি কেড়ে নেন।

কবিতাটি সেই সময়ের বাংলায় বিদ্যমান সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি শক্তিশালী নিন্দা। এটি দেখায় যে কীভাবে দরিদ্র এবং ঝুঁকিপূর্ণদের প্রায়শই শক্তিশালী এবং সুবিধাভোগী দ্বারা শোষণ করা হয়। কবিতাটিও মানুষের আত্মার অমিত শক্তির কথা বলে। যে অবিচার তিনি ভোগ করেছেন তার পরেও কৃষক এখনও তার জমি ফিরে পেতে এবং তার জীবন পুনর্নির্মাণ করতে আশা করে।

কবিতাটি আজও প্রাসঙ্গিক, যেহেতু এটি ভারতে চলমান বৈষম্য সমস্যার কথা বলে। কবিতাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমাদের অবশ্যই সকল মানুষের জন্য ন্যায়বিচার এবং সমতা অর্জনের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, তাদের সামাজিক শ্রেণী নির্বিশেষে।

শ্রেণি বৈষম্য এবং অবিচারের বিষয়গুলির পাশাপাশি, কবিতাটি প্রেম, আশা এবং স্বপ্নের বিষয়গুলিও অনুসন্ধান করে। কৃষকের দুটি বিঘা জমি তার জীবিকার একমাত্র উৎস ছিল না। তারা তার পরিবারের প্রতি তার ভালবাসার প্রতীকও ছিল এবং তার ভবিষ্যতের জন্য তার আশা ছিল। জমিদার যখন জমিটি কেড়ে নেয়, তখন তিনি শুধুমাত্র কৃষকের জীবিকাই নয়, তার স্বপ্ন এবং তার আশার অনুভূতিও কেড়ে নেয়।

কবিতাটি কৃষক তার একদিন তার জমি ফিরে পাবে বলে আশা প্রকাশ করে শেষ হয়। এই আশা একটি শক্তিশালী স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এমনকি অবিচারের মুখেও, মানুষ এখনও স্বপ্ন দেখতে এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করতে পারে।

“দুই বিঘা জমি” একটি চলমান এবং শক্তিশালী কবিতা যা মানুষের অবিচার এবং অত্যাচারের অভিজ্ঞতার কথা বলে। এটি একটি কবিতা যা আজও প্রাসঙ্গিক, যেহেতু এটি ভারত এবং বিশ্বজুড়ে চলমান বৈষম্য সমস্যার কথা বলে।

এই কবিতাটিতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার গ্রামীণ সমাজের শ্রেণীবিভেদ আর দুর্বলের উপর সবলের অনাচার-অবিচার নিয়ে লিখেছেন। এই কবিতায় গরীব শ্রেণীর অসহায়ত্বের দিক দেখানো হয়েছে।

Also Read: বনলতা সেন কবিতা- জীবনানন্দ দাশ

কবিতাটির প্রথম ছত্রে বলা হয়েছে যে, কবির দুটি বিঘা জমি ছিলো। সেই জমিতে তিনি তার সমস্ত স্বপ্ন বুনেছিলেন।

দ্বিতীয় ছত্রে বলা হয়েছে যে, সেই জমিতে তিনি তার ভালোবাসা, আশা, স্বপ্ন বুনেছিলেন।

তৃতীয় ছত্রে বলা হয়েছে যে, সেই জমিটা একজন অত্যাচারী জমিদার কেড়ে নিলেন।

চতুর্থ ছত্রে বলা হয়েছে যে, সেই জমিদার কবির সবকিছু কেড়ে নিলেন।

পঞ্চম ছত্রে বলা হয়েছে যে, কবি সেই জমিটার পথ চেয়ে আছেন।

ষষ্ঠ ছত্রে বলা হয়েছে যে, কবি চান যে, সেই জমিটা তার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

সপ্তম ছত্রে বলা হয়েছে যে, কবি সেই জমিতে আবার তার ভালোবাসা, আশা, স্বপ্ন বুনবেন।

দুই বিঘা জমি কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় কবিতা। এই কবিতাটি বাংলার গ্রামীণ সমাজের শ্রেণীবিভেদ আর দুর্বলের উপর সবলের অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদ।

দুই বিঘা জমি কবিতা আবৃত্তি | Dui Bigha Jomi Kobita

দুই বিঘা জমি কবিতা পিডিএফ

উপসংহার:

“দুই বিঘা জমি” কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। কবিতাটির মানবিক বার্তা আজও সমাজের জন্য প্রাসঙ্গিক।