
বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত কম্পিউটার নেটওয়ার্কের এই অপূর্ব জাল – ইন্টারনেট – আমাদের জীবনধারাকে মূলত পাল্টে দিয়েছে। এটি শুধু জ্ঞানের মহাসাগর ও বিনোদনের কেন্দ্রই নয়, সামাজিক যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা – সবকিছুকেই আমূল বদলে দিয়েছে। তবে, সচেতন না হলে ইন্টারনেটের ঝুঁকিগুলোও উপেক্ষা করা যায় না।
Table of Contents
ইন্টারনেট কী? | Internet kake bole bangla

ইন্টারনেট: এটি একটি বিশ্বব্যাপী জাল, যেটা সমস্ত বিশ্বের কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাথে পরস্পরে সংযুক্ত হয়ে আছে। এই কম্পিউটার নেটওয়ার্ক পরস্পরে একে আরেকটি ডিভাইসের সাথে বিশ্বব্যাপী ভাবে লিংক বা কানেক্ট হওয়ার জন্য “Internet protocol suite (TCP/IP)” ব্যবহার করে। এই প্রোটোকলের মাধ্যমে আপনি যেকোনো ডিভাইসে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন, যেমন মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টিভি, এবং অন্যান্য ডিভাইস। ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমরা তথ্য, মিডিয়া, সেবা, এবং অন্যান্য কাজ সহজে করতে পারি।
ইন্টারনেট এর জনক কে?
ইন্টারনেটের একক জনক নেই। ইন্টারনেটের বিকাশ ও উন্নয়নে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবদান রয়েছে। তবে, “ইন্টারনেটের জনক“ হিসেবে ভিন্টন সার্ফ (Vinton Cerf) এবং রবার্ট কান (Robert Kahn)-কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।
ভিন্টন সার্ফ (Vinton Cerf) এবং রবার্ট কান (Robert Kahn) ১৯৭০-এর দশকে TCP/IP প্রোটোকল তৈরি করেন, যা আধুনিক ইন্টারনেটের ভিত্তি স্থাপন করে।
ভিন্টন সার্ফ (Vinton Cerf)-কে “ইন্টারনেটের পিতামহ” এবং রবার্ট কান (Robert Kahn)-কে “ইন্টারনেটের স্থপতি” বলা হয়।
ইন্টারনেটের ব্যবহার: সুবিধা ও অসুবিধা

ইন্টারনেট আমাদের জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। জ্ঞান, যোগাযোগ, বিনোদন, ব্যবসা, শিক্ষা – সকল ক্ষেত্রেই এর প্রভাব স্পষ্ট।
ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা:
- জ্ঞানের ভাণ্ডার: ইন্টারনেট জ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার। যেকোনো বিষয়ে তথ্য সহজেই পাওয়া যায়।
- যোগাযোগের মাধ্যম: ইমেইল, সোশ্যাল মিডিয়া, ভয়েস ও ভিডিও কলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ করা সম্ভব।
- শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: অনলাইন কোর্স, ভিডিও টিউটোরিয়াল, এবং ই-বুকের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করা সহজ হয়েছে।
- ব্যবসার প্রসার: অনলাইন শপিং, ই-কমার্স, এবং ডিজিটাল মার্কেটিং ব্যবসার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সরকারি সেবা: অনলাইনে বিভিন্ন সরকারি সেবা পাওয়া যায়।
- বিনোদনের বিকল্প বৃদ্ধি: ইন্টারনেটে গান, সিনেমা, গেমস, এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক উপাদানের অফুরন্ত বিকল্প রয়েছে।
- সময় ও অর্থের সাশ্রয়: অনলাইনে অনেক কাজ দ্রুত ও কম খরচে করা সম্ভব।
- বিশ্বায়নের প্রসার: ইন্টারনেট বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে।
ইন্টারনেট ব্যবহারের অসুবিধা:
- তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা: ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সবসময় নিশ্চিত নয়।
- সাইবার অপরাধ: সাইবার অপরাধ, যেমন হ্যাকিং, ফিশিং, এবং আইডেন্টিটি চুরি, একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা।
- অনলাইন আসক্তি: অনলাইনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
- ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন: ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে শেয়ার করার ফলে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকি থাকে।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহার সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণ হতে পারে।
- শিশুদের উপর প্রভাব: অনুপযুক্ত বিষয়বস্তু, সাইবার বুলিং, এবং অনলাইন শিকারীদের ঝুঁকি থাকে।
- মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব: সাইবার বুলিং, নেতিবাচক মন্তব্য, এবং অনলাইন সমালোচনা মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে।
- শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব: দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের সমস্যা, ঘাড়ের ব্যথা, এবং অনিদ্রা হতে পারে।
- কর্মক্ষেত্রে প্রভাব: কর্মক্ষেত্রে ইন্টারনেটের অপব্যবহার কর্মক্ষমতা হ্রাস
আরও পড়ুনঃ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা
ইন্টারনেট কিভাবে কাজ করে?
ইন্টারনেট হলো বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত কম্পিউটার নেটওয়ার্কের এক বিশাল সমাহার। এটি বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজ করে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
১) ডেটা প্যাকেট:
ইন্টারনেটে ডেটা ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে পাঠানো হয়, যাকে ডেটা প্যাকেট বলা হয়। প্রতিটি প্যাকেটে ডেটা, উৎস ও গন্তব্যের ঠিকানা এবং অন্যান্য তথ্য থাকে।
২) রাউটিং:
ডেটা প্যাকেটগুলো উৎস থেকে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন রাউটারের মাধ্যমে যাত্রা করে। রাউটার হলো এমন ডিভাইস যা ডেটা প্যাকেটগুলোকে সঠিক পথে পাঠিয়ে দেয়।
৩) প্রোটোকল:
ইন্টারনেটে ডেটা আদান-প্রদানের জন্য বিভিন্ন প্রোটোকল ব্যবহার করা হয়। প্রোটোকল হলো নিয়মকানুনের এক সেট যা ডেটা পাঠানো, গ্রহণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে নির্দেশিকা প্রদান করে। উল্লেখযোগ্য প্রোটোকলগুলোর মধ্যে রয়েছে TCP/IP, HTTP, FTP, DNS ইত্যাদি।
৪) নেটওয়ার্কিং ডিভাইস:
ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন ও ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে মডেম, রাউটার, সুইচ, ওয়াই-ফাই রাউটার ইত্যাদি।
৫) ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ISP):
ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ISP) হলো এমন প্রতিষ্ঠান যা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহ করে।
ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র:
- কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ইত্যাদি ডিভাইস
- ইন্টারনেট সংযোগ
- ওয়েব ব্রাউজার (যেমন: Google Chrome, Mozilla Firefox)
ইন্টারনেট সম্পর্কিত তথ্য
ব্রাউজার কি?
ব্রাউজার একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রাম, যার সাহায্যে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করা যায়। গুগল ক্রোম একটি জনপ্রিয় ওয়েব ব্রাউজার।
URL কি?
URL এর পূর্ণরূপ হল ইউনিক রিসোর্স লোকেটার। যা ইন্টারনেটে একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা। URL কে ওয়েব ঠিকানাও বলা হয়।
ডাউনলোড এবং আপলোড কি?
ইন্টারনেটের সাহায্যে, যখন কোনও ওয়েবসাইট থেকে ক্লায়েন্টের কম্পিউটারে কোনও ডেটা ট্রান্সফার করা হয়, তখন সেই প্রক্রিয়াটিকে ডাউনলোড বলা হয়। এর সাথে, যখন কোনও ডেটা ক্লায়েন্ট থেকে ওয়েবসাইটের সার্ভারে ট্রান্সফার করা হয়, তখন সেই প্রক্রিয়াটিকে আপলোডিং বলা হয়।
বাংলাদেশে কবে ইন্টারনেট শুরু হয়?
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। তবে তখন এটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারত। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ইন্টারনেট সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
- ১৯৯৩: অফলাইন ই-মেইলের মাধ্যমে সীমিত আকারে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়।
- ১৯৯৬:
- ৬ জুন: বাংলাদেশে প্রথম ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া শুরু করে “ইনফরমেশন সিস্টেম নেটওয়ার্ক” (আইএসএন)।
- দেশে প্রথম ইন্টারনেটের জন্য ভিস্যাট স্থাপন করা হয়।
- ১৯৯৭:
- বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ইন্টারনেট সেবা প্রদান শুরু করে।
- বাংলাদেশের প্রথম ওয়েবসাইট “বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড” (বিটিসিএল) চালু হয়।
- ১৯৯৮:
- বেসরকারি পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়।
- “সিটিসেল” (বর্তমানে রবি) প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইন্টারনেট সেবা প্রদান শুরু করে।
- ২০০০:
- মোবাইল ফোনে জিপিআরএস-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হয়।
- বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
- ২০০৮:
- 3G মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হয়।
- বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যায়।
- ২০১০:
- বাংলাদেশে সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং হয়।
- বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা 2.5 কোটি ছাড়িয়ে যায়।
- ২০১৮:
- 4G মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হয়।
- বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা 8 কোটি ছাড়িয়ে যায়।
- ২০২০:
- বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা 10 কোটি ছাড়িয়ে যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা 12 কোটিরও বেশি।
ইন্টারনেট সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর
ইন্টারনেট কে আবিস্কার করেন?
আমেরিকান বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স লি 1969 সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার করেন। ইন্টারনেট আবিষ্কারে অনেক দীর্ঘ সময় লেগেছে।
ইন্টারনেটের পুরো নাম কী?
ইন্টারনেটের পুরো নাম – Inter Connected Network (ইন্টার কানেক্ট নেটওয়ার্ক) ।
বাংলাদেশে কবে ইন্টারনেট শুরু হয়?
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে। তবে তখন এটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারত। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ইন্টারনেট সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
ভারতে কবে ইন্টারনেট শুরু হয়?
1995 সালে 15ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন ভারতে প্রথম ইন্টারনেট শুরু হয়েছিল। ইন্টারনেট পরিষেবা প্রথম শুরু করেছিল বিদেশ সঞ্চার নিগম লিমিটেড। প্রাইভেট কোম্পানির জন্য ইন্টারনেট 1998 সালে খোলা হয়েছিল।
বাংলায় ইন্টারনেটকে কি বলে?
ইন্টারনেটকে সাধারণত বাংলায় ইন্টারনেটই বলা হয় কিন্তু এর আক্ষরিক অর্থ হল ‘আন্তর্জাল’।